মি-য়াঁ-ও ভয়ংকর এক রহস্য রোমাঞ্চ গল্প
বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়
কালকের মতোই আজকেও সন্ধা থেকে শুরু হল গুড়ি–গুড়ি বৃষ্টি। তবুও আজকে তো যেতেই হবে। আজকে মাস্টার দাদুর ভূতের গল্প বলার কথা। আজকে না গেলে আবার সেই রবিবারের অপেক্ষা। সপ্তাহের একটা দিন মাত্র গল্প, বাকি ছয়দিন পড়া আর পড়া। দাদু যে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলেন সেটা কেউ না বুঝলেও আমি ঠিক বুঝতে পারি। তবুও শুনতে বেশ ভালই লাগে। “চাঁদনী রাতের চিতা” গল্পটা আমার দারুণ লেগেছিল। কদিন রাতে তো একা একা বাথরুম যেতেও ভয় পাচ্ছিলাম। মিলি আর অন্তুও নিজেদের মুখেই মেনেছিল ওদের ভয় লাগার কথা। ভয় পেয়েও একমাত্র কল্লোল সেটা কিছুতেই মানেনি। ওর ভাব এমন যেন ও একাই মেসি কিংবা মারাদোনা, বাকি সবাই চারাপোনা। ফালতু ছেলে একটা…
বৃষ্টি ছাড়ার অপেক্ষা না করেই ছাতা আর টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মাস্টার দাদুর আবার একটা বদ অভ্যাস আছে, গল্প বলার দিন কারু জন্য অপেক্ষা না করেই শুরু করে দেন। অথচ যেদিন পড়া দেওয়া থাকে সেদিন ঠিক অপেক্ষা করেন।
এদিকে রাস্তায় বেশ ভালই বৃষ্টির জল জমেছে। রাস্তা ধারের ডোবাগুলো থেকে হরেকরকম ব্যাঙের সুর ভেসে আসছে এখন। ব্যাঙের ডাক আর ছাতার উপর বৃষ্টির শব্দ মাথায় নিয়ে আমি চবক–চবক করে চলেছি। সময় তো একটু বেশি লাগবেই। আজকে আবার কল্লোলদের বাড়িতে নয়, ওদের বাড়ি মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। মিলিদের বাড়িটা আমাদের বাড়ি থেকে একটু বেশিই দূরে। কিন্তু মাস্টার দাদু সেটা বুঝবেন না। ঠিক শুরু করে দেবেন।
[এক] রহস্য রোমাঞ্চ
শেষমেশ আমি যখন মিলির পড়ার ঘরে ঢুকলাম তখন মাস্টার দাদু এসে গেছেন। গল্প শুরুর মুখে। অন্তু আর কল্লোল মাস্টার দাদুর গা ঘেঁষে বসেছে আজ। মিলি ওর প্রতিদিনের জায়গাতেই। মাস্টার দাদুর পাশে জায়গা নেই দেখে বাধ্য হয়েই আমাকে অল্প দূরে বসতে হল। দেরি করে এলে যা হয়…
“আজকে যে গল্পটা বলব সেটা বছর চল্লিশ আগের গল্প…” প্রতি রবিবারের মতো আজকেও বেশ জমিয়েই শুরু করলেন মাস্টার দাদু, “তোরা তো আমার গল্প বিশ্বাস করিস না, যদিও তোরা বিশ্বাস না করলেও সত্যিটা সত্যিই থাকবে।”
“বিশ্বাস করি তো। ওই চিতা বাঘের গল্পটা আমার বাবাও বলেছে সত্যি গল্প।”
“শুনলি তো কল্লোল মিলির বাবা কী বলেছে ? যাই হোক গল্পটা মন দিয়ে শুনবি। আর হ্যাঁ, গল্পের মাঝে কিছু জিজ্ঞেস করবি না। যা জানার সব গল্পের পরে জেনে নিস… সময়টা ছিল কার্তিক মাসের মাঝামাঝি। কোজাগরী পূর্ণিমার দুদিন পরের ঘটনা। সেদিন দুপুর থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। এক মিনিটের জন্যেও মনে হচ্ছিল না যে আজকে আর বৃষ্টি থামবে। কিন্তু রাত্রি আটটা না বাজতে বাজতেই মেঘ কেটে ঝলমলে চাঁদ বেরিয়ে এলো আকাশে। আমি তখন কি যেন বেশ একটা উপন্যাস পড়ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে। ঠিক এমন সময় তারাপদ এলো আমাদের ঘরে…”
“তারাপদ ? ওটা আবার কে ?” জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলাম না।“তারাপদ ছিল আমাদেরই পাড়ার ছেলে। ও আমার কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘মণ্ডল পুকুরের উজানে প্রচুর মাছ উঠছে। যাবি ?’ সেই সময় বয়সটা ছিল কম। সাহসেরও অভাব ছিল না। এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলাম। বাবা মা যখন ঘুমিয়ে পড়ল তখন নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম আমি। দরজার বাইরে বেরিয়ে দেখলাম তারাপদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
“তারপর ?” মাস্টার দাদুর কাছাকাছি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল মিলি।“তারপর তারাপদর পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করলাম। কেউ যেন জানতে না পারে। তাই খুব সাবধানে হাঁটছিলাম আমরা দুজন। আকাশে দু–এক টুকরো কালচে মেঘ দেখা গেলেও বৃষ্টি আসার আর সম্ভাবনা ছিল না। ঝলমলে জ্যোৎস্নায় পাকা ধানের জমিগুলোকে কাঁচা সোনার ক্ষেত বলে মনে হচ্ছিল দূর থেকে। তারাপদ ছিল বরাবরের বোহেমিয়ান। ওর সঙ্গে ধানের আল দিয়ে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছিল আমার। পা পিছলে যাচ্ছিল বারবার। মনে হচ্ছিল মাছের আঁশটে গন্ধের লোভে ও যেন লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে মণ্ডল পুকুরের দিকে। ‘চল তাড়াতাড়ি চল। মাছগুলো তো জলে নেমে যাবে।’ হাঁটতে হাঁটতে ওই এক বারই কথা বলেছিল ও আমার সঙ্গে। অথচ অন্যান্যদিন ছেলেটা সবসময় বকবক করত। মুখ বন্ধ করে বেশিক্ষণ থাকতেই পারত না ও…” গল্পের মাঝ রাস্তায় থেমে মিলিদের ভেতর ঘরে যাওয়ার দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে মাস্টার দাদু মিলিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তেলাপিয়া মাছ ভাজছে তোর মা ?”
এক গাল হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল মিলি।‘‘আজও মণ্ডল পুকুরের মাছের গন্ধ আমি ঠিক চিনতে পারি…”“দাদু গল্পটা…” কল্লোল মাস্টার দাদুকে মনে করিয়ে দিল একবার।“হ্যাঁ, কখনো ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে, কখনো প্রায় হাফ–হাঁটু কাদা রাস্তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দুজনে পৌঁছলাম মণ্ডল পুকুরে।
মণ্ডল পুকুরে পৌঁছে সত্যিই আমার চক্ষু চড়কগাছ। জল নামার পুরো উজানটা জুড়েই মাছ ঝাঁপাচ্ছে। যখন পুকুরে জল নামছিল তখন জলের রেখা ধরে উপরে উঠে এসেছিল মাছগুলো। বৃষ্টি ছাড়িয়ে যাওয়ার পর আর নামার সুযোগ পায়নি। পাগলের মতো মাছ কুড়োতে শুরু করলাম দুজনে। মনে মনে হিসেব কষে নিলাম, কত কেজি বিক্রি করব আর কতটা বাড়ির জন্য রাখব। আমি তো ব্যাগ নিয়ে যাইনি। তাই তারাপদর ব্যাগটাতেই ভরছিলাম আমিও। যা হবে সমান সমান। মিনিট কুড়ির ভেতর একটা অদ্ভুত ঘটনা খেয়াল করলাম। দুজনে মিলে টপাটপ মাছ কুড়চ্ছি আর ভরছি তবুও ব্যাগ ভরছে না কিছুতেই…”
“বড় ব্যাগ ছিল ?” জিজ্ঞেস করল অন্তু।“হ্যাঁ তা একটু বড় ছিল ঠিকই। তাই বলে ব্যাগটা না ভরার মতোও ছিল না। প্রায় দুঘণ্টা ধরে মাছ কুড়িয়ে কুড়িয়ে যখন আমার হাঁটু আর কোমরে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে ঠিক তখন খেয়াল করলাম ঘটনাটা…” ইচ্ছে করেই দাঁড়িয়ে পড়লেন মাস্টার দাদু। বললেন, “তোরা হলে সেদিনই হার্টফেল করে মরে যেতিস।”
“কেন কী হয়েছিল ?” গলাটা মনে হয় শুকিয়েছে কল্লোলের।“হঠাৎ খেয়াল করলাম, তারাপদ যেন ঠিক তারাপদ নয়। ওর হাত–পা গলা সব কেমন যেন লাগছিল। চোখ দুটোও কেমন যেন বিড়ালের মতো। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার মনের ভ্রম। কিন্তু কয়েক মিনিটের ভেতরই খেয়াল করলাম, কাঁচা মাছ খাচ্ছে তারাপদ। শরীরের জল মোছার কায়দায় মুখের রক্ত মুছছে জামার হাতায়। চাঁদের আলোতে পরিষ্কার দেখাচ্ছে ওর জামার দু‘হাতায় রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। ভয়ে সারা শরীর হিম হয়ে পড়েছিল আমার। তবুও ওকে বুঝতে দিইনি আমি। আমি মাছ কুড়িয়েই যাচ্ছিলাম।”
“তারপর কি হল ?” মাস্টার দাদুর চেয়ারের এক্কেবারে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল মিলি ।“ভোরের দিকে তারাপদও বুঝতে পারল যে আমি সব বুঝে গেছি। ও একটা বড় মাপের মাছ মুখে পুরতে যাওয়ার সময় আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছিল ওর। হাতে–নাতে ধরা পড়াটা মেনে নিতে পারেনি ও। হয়তো তাই মাছের ব্যাগ ফেলে, চোখ দুটোকে হিংস নেকড়ের মতো গোল্লা পাকিয়ে‘মি–য়াঁ–ও, মি–য়াঁ–ও’ করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর…”
“তারপর ?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।“হিংস বিড়ালের মতো তারাপদ কামড়ে ধরল আমার গলাটা। আমি হাজার চেষ্টা করেও ওকে কিছুতেই ছাড়াতে পারলাম না। সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল আমার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। একটা সময় আস্ত একটা বিড়ালে পরিণত হল তারাপদ। ততক্ষণে আমি লুটিয়ে পড়েছি। সম্ভবত তারাপদর ভয়ংকর চেহারা আর চোখ দেখেই জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি। এর পরের ঘটনা আরও ভয়ংকর।”
[দুই] ক্রমাগত রহস্য রোমাঞ্চ
গল্পটা অসম্পূর্ণ রেখেই মাস্টার দাদু কয়েক মিনিটের জন্য বাইরে গেলেন। আমরা চুপচাপ বসে রইলাম। কারু মুখে কোনও টুঁশব্দও নেই। এমনকি কল্লোল পর্যন্ত আজ গুম মেরে গেছে। মাস্টার দাদু বাইরে থেকে ফিরেই শুরু করলেন, ‘সেদিনের পর গ্রামে আর তারাপদকে দেখা যায়নি। ও যে কোথায় চলে গেল কেউ জানে না।
আমার এক দূর সম্পর্কের কাকা সেদিন ভোরে পুকুর গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় আমাকে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। তেরদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম আমি। সুস্থ হতে প্রায় মাস দুয়েক সময় লেগেছিল। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ আর হলাম কোথায়…!’ একটা বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দাদু, ‘একদিন হঠাৎ কেন যেন মনে হল, আমি যেন আমি নই। আমার ভেতর অন্যকিছু বা অন্যকেউ যেন আছে। একটা চাপা ভয় পেয়ে বসল আমাকে। এভাবেই ভয়ে ভয়ে কটা দিন কাটল আবার। তারপর একদিন মাঝ রাতে বাথরুম থেকে ফিরে আনমনে আয়নার সামনা–সামনি হতেই চমকে উঠলাম।
আয়নায় আমার মুখের প্রতিবিম্ব ছিল না। ছিল একটা কালো বিড়ালের…’ কথাটা শুনেই মিলি অন্তু ওরা পিছিয়ে এলো কয়েক হাত।‘…এরপর যতদিন যায় ততই যেন নিজেকে বিড়াল মনে হয়। ভাজা মাছের সঙ্গে সঙ্গে কাঁচা মাছের প্রতিও লোভ বাড়তে থাকে। এক একদিন নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে মিয়াঁও ডাকটাও বেরিয়ে আসত। অনেক ডাক্তার–কবিরাজ দেখালাম, কিছুতেই কিছু হল না। সব ডাক্তার বলত মানসিক সমস্যা।
অথচ মানসিক ডাক্তার দেখিয়েও কিছুই লাভ হল না। একবার এক ডাক্তার তো আমাকে নিয়ে সবার সামনে তামাশা শুরু করেছিলেন। আমারও খুব রাগ চেপে গিয়েছিল মাথায়। আমার শারীরিক কোনও পরিবর্তন দেখেই হয়তো উনি জ্ঞান হারিয়েছিলেন। এরপর থেকে ধীরে–ধীরে একা হয়ে গেলাম। ঘর বানালাম গ্রামের এক প্রান্তে। কারু সঙ্গেই বিশেষ কথা বলতাম না। স্কুল থেকে ফিরে চুপচাপ বসে থাকতাম…’
মাস্টার দাদুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘরে ঢুকল মিলির আদরের কুকুর ডাম্বু। ডাম্বু ঘরে ঢুকেই মাস্টার দাদুর সামনে দাঁড়িয়ে ঘেউঘেউ শুরু করে দিল। মিলি চেষ্টা করেও থামাতে পারল না ওকে। বারেককে রাগ বাড়ছিল ডাম্বুর। মাস্টার দাদুকে কিছুতেই ঘরে থাকতে দেবে না ও। ডাম্বুর চিৎকার শুনে অ্যান্টিও ছুটে এলো রান্নাঘর থেকে। কিন্তু উনিও থামাতে পারলেন না ডাম্বুকে। এর পর যেটা ঘটল সেটার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।
ঘেউ ঘেউ করতে করতেই ডাম্বু হটাৎ ঝাঁপিয়ে খপ করে কামড়ে ধরল মাস্টার দাদুর ডান হাতটা। যন্ত্রণায় মাস্টার দাদুরও “মি–য়াঁ–ও” করে চেঁচিয়ে উঠলেন।আমাদের চোখের সামনেই রূপ পাল্টে গেল মাস্টার দাদুর। রাগে জ্বলজ্বল করে উঠল চোখ দুটো। আমরা সবাই ভয়ে অ্যান্টির কোল ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবার যেন বেশ ভয় পেয়েছে ডাম্বুও। মাস্টার দাদুর হাত ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে এসেছে ও। ঘেউ ঘেউ করছে আরও বেশি। মাস্টার দাদু এবার আমাদের দিকে তাকিয়ে ঝকঝকে দাঁত বের করে বিকট “মি–য়াঁ–ও” শব্দে যেন কিছু বোঝাতে চাইলেন। তারপর এক লাফে ডাম্বুর গলাটা ধরে তুলে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন বাইরের অন্ধকারে।অ্যান্টির কান্নার শব্দেই হয়তো পাশাপাশি বাড়ির দু’একজন ছুটে এসেছিল। মুহূর্তের ভেতর সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। হই–হই করে ছুটে এলো সবাই।অনেক খোঁজাখুঁজির পর ডাম্বুকে মণ্ডল পুকুরের একটা কোনায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। ওর শরীরে প্রাণের কোনও চিহ্ন নেই। গলার প্রায় পুরোটাই ক্ষতবিক্ষত। ডাম্বুর মৃত দেহটার কাছাকাছি বড় বিড়ালের পায়ের ছাপ পাওয়া গেলেও বড় বিড়াল বা মাস্টার দাদুকে কোথাও আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
[সমাপ্ত]